সমস্ত লেখাগুলি

ঈশ্বরকণা ঈশ্বরের জিয়নকাঠি না মৃত্যুবাণ -
সাধন কুমার ঘোষ
Nov. 20, 2024 | নাস্তিকতা | views:7813 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১ম পর্ব

      নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মিওন লিওন লেডারম্যান (M.।.Lederman) সম্প্রতি (03.10.18) আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন তাঁর (বিজ্ঞান লেখক ডিক টেরেসির সঙ্গে যৌথভাবে) লেখা সাড়া জাগানো বই 'ঈশ্বর কণা' (ইংরেজীতে The God Particle: If the Universe is the answer, what is the question? 1993)। লেডারম্যান নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৮৮ সালে, সাব অ্যাটমিক পার্টিকল নিউট্রিনো আবিস্কারের জন্য, এ তথ্য হয়ত খুব কম লোকই জানেন, কিন্তু তাঁর লেখা 'ঈশ্বর কণা' বইটির নাম শোনেননি এমন মানুষ কমই আছেন। বইটির অসম্ভব জনপ্রিয়তার জন্য এর নামের সঙ্গে 'God' শব্দটি অনেকাংশেই কৃতিত্ব দাবী করতে পারে। এ নামটির মধ্যে দিয়েই যেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমান বইটিতে  পাওয়া গেছে, তাই এত শোরগোল। স্বীকার করতেই হবে God শব্দটি জুড়ে দিয়ে প্রকাশক যথেষ্ট ব্যবসায়িক বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন। আর স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর লেখা বই-এর নামে God বা ঈশ্বর জুড়ে যাওয়া ঈশ্বর বিশ্বাসীদের কাছে আত্মশ্লাঘার বিষয় বইকি। আসলে বিজ্ঞানচর্চা মানুষের জ্ঞানের পরিধিকে যতটা প্রসারিত করেছে বিশ্বব্রহ্মান্ডের রহস্য তত তার কাছে উন্মোচিত হয়েছে, আর এর ফলে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ঈশ্বরের স্থান ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়েই চলেছে। কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বাসীরাও হাল ছাড়েননি, বিজ্ঞান যেমন ঈশ্বরের জগতে থাবা বসিয়ে চলেছে, ঈশ্বর বিশ্বাসীরাও যেন খোদ বিজ্ঞানকেই (আসলে বিজ্ঞানের ছোঁয়া) ততবেশী আঁকড়ে ধরতে চাইছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানে, কারন বিজ্ঞানের একটু ছোঁয়া থাকলে সেটা সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়, এটাই তাঁদের ধারনা, যতই তাঁরা বিজ্ঞানকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকুন না কেন।

        'ঈশ্বরকণা' কি তবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সুক্ষতম রূপ? এটাই কি ছিল বইটির প্রামাণ্য বিষয়? এ আলোচনায় যাওয়ার আগে সাধারন ভাবে আমরা পদার্থ বিজ্ঞানের সংশ্লিষ্ট বিষয়টা একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব। বিদ্যালয় স্তরের ছাত্ররা জানে সমস্ত পদার্থ অতি ক্ষুদ্র অনু দিয়ে গঠিত, আবার সমস্ত অনু মৌল কণা পরমানু' (প্রায় ১০০টি) দ্বারা গঠিত। কিন্ত পরমানুগুলিও গঠিত হয় আরও সুক্ষ কণা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন দ্বারা। আর পদার্থ বিজ্ঞানের যে শাখায় এসমস্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় সেটা হল পার্টিকল ফিসিক্স। এখানে আলোচিত প্রাথমিক কণাগুলি (Elementary বা fundamental particle) হচ্ছে সাব অ্যাটমিক পার্টিকল যাদের কোনো সাব স্ট্রাকচার এখনও পর্যন্ত জানা নেই। দেখা যাচ্ছে এরূপ প্রাথমিক কণার সংখ্যাও প্রায় একশত। আলোচ্য 'ঈশ্বর কণা' আসলে এরকম একটি এলিমেন্টারি সাব অ্যাটমিক পার্টিকল, যার কিছু বৈশিষ্টের জন্য একে দিয়েছে অনন্যতা। যাইহোক পদার্থ বিজ্ঞানে এইসব প্রাথমিক কণাই হল পদার্থ আর শক্তির (যারা একে অপরটিতে পরিবর্তিত হতে পারে) ক্ষুদ্রতম একক। পার্টিকল ফিসিক্সের স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে সব প্রাথমিক (elementary) কণাগুলিকে প্রধান দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, 

১) ফান্ডামেন্টাল ফার্মিয়ন, এদের স্পিন হল অর্ধপূর্ণ সংখ্যা

২) ফান্ডামেন্টাল বোসন, এদের স্পিন হল পূর্ণ সংখ্যা। 

এখনও পর্যন্ত জানা তথ্য অনুসারে ফার্মিয়নগুলি (আপ ডাউন চার্ম ইত্যাদী কোয়ার্ক, অ্যান্টি কোয়ার্ক, লেপ্টন, অ্যান্টি লেপ্টন গুলি) পদার্থের বিল্ডিং ব্লক, আর বোসনকণা গুলিকে (গেজ বোসন, হিগস বোসন গ্রাভিটন ইত্যাদী) বলা যায় বল বাহী কণা বা ফোর্স পার্টিকল। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস ও আলবার্ট আইনস্টাইন মিলে গত শতকের বিশের দশকে যে কোয়ান্টাম সাংখ্যায়ন (বোস-আইনস্টাইন সাংখ্যায়ন) প্রবর্তন করেছিলেন সেটা মেনে চলা মৌল কণা গুলিকেই বোসন শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। আলোচ্য ঈশ্বর কণা আদতে হল একটি বোসন কণা; বৈজ্ঞানিক মহলে এর স্বীকৃত নাম 'হিগস-বোসন'; কোন 'ঈশ্বর কণা' নয়। আবার একাধিক এলিমেন্টারী পার্টিকল দিয়ে তৈরী হতে পারে কম্পোজিট পার্টিকল। কোয়ান্টাম তত্বানুসারে এলিমেন্টারী পার্টিকল আপ ও ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে কম্পোজিট পার্টিকল গঠিত হয় যেমন প্রোটন, নিউট্রন গঠিত। এখন ফোর্স পার্টিকলগুলি যেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বাহক অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড মডেলে যে চারটি ফান্ডামেন্টাল বলের (weak force, electromagnetic force, strong force, gravitation) কথা বলা হয়েছে তাদের বাহক, যেমন ফোটন হল তড়িৎ চুম্বক ক্ষেত্রের বাহক, আমাদের আলোচ্য হিগস বোসন কণা হিগস ক্ষেত্রের বাহক, তেমনি অভিকর্ষ ক্ষেত্রের বাহক ভাবা হয় গ্রাভিটন কণাকে যদিও আমরা এর প্রমাণ পাইনি, যেটা সম্প্রতি পাওয়া গেছে হিগস-বোসন এর ক্ষেত্রে। এই বিষয়ে যাওয়ার আগে আমাদের আরও কিছু বিষয় বুঝে নিতে হবে।

       হিগস ক্ষেত্র ও হিগস মেকানিজম : বিজ্ঞানী পিটার হিগস প্রস্তাবিত একটি শক্তি ক্ষেত্র বিশ্বব্রহ্মান্ডের সর্বত্র বিরাজ করছে আর এই ক্ষেত্রের সঙ্গে বিভিন্ন মৌল কণার মিথষ্ক্রিয়ার (interaction) ফলেই কণা গুলি ভর অর্জন করে। এই ক্ষেত্রের নাম হিগস ক্ষেত্র ও হিগস বোসন হল এই ক্ষেত্রের বাহক কণা (quanta)। যে প্রক্রিয়ায় হিগস ক্ষেত্রের সঙ্গে মৌলকণারা মিথস্ক্রিয়া করে সেটাই হল হিগস মেকানিজম। গত শতকের ষাটের দশকে ভরহীন মৌল কণাদের ভর প্রদান করে এমন একটি কণা বা ক্ষেত্রের তাত্বিক সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছিলেন বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী পিটার হিগস, ইংল্যান্ডের ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলাট সহ কয়েকজন বিজ্ঞানী ও ১৯৬৪ সালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষনা পত্র প্রকাশিত হয়, এই কণাটিই হিগসের নামে হিগস কণা ও ক্ষেত্রের নামকরন করা হয় হিগস ক্ষেত্র। এখন মিথস্ক্রিয়ার মাত্রার উপর ভর নির্ভর করে, বেশী ভরের কণা অর্থাৎ হিগস ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাত্রা বেশী, কম ভরের ক্ষেত্রে মিথস্ক্রিয়ার মাত্রা কম। এই যে হিগস ক্ষেত্র বা কণা প্রাথমিক কণা গুলিকে ভর দেয় এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারন কণাগুলি ভর পেলেই তবে তাদের উপর মহাকর্ষ বল কাজ করতে পারে তারা একত্রিত হয়ে জোট বাঁধতে পারে, ফলে অনু-পরমানু, গ্রহ, নক্ষত্র সব কিছু তৈরী হতে পারে। যদিও মহাকর্ষের সঙ্গে হিগস ক্ষেত্রের সম্পর্ক এখনও পরিস্কার নয়। আবার হিগস ক্ষেত্র সব কণাকে ভর দেয় না, সবটা ভরও দেয় না। হিগস মিথস্ক্রিয়ায় শুধু অন্তর্নিহিত ভর পায়, কিন্তু মহাকর্ষ বস্তুর সমগ্র শক্তির উপর কাজ করে, শুধু ভরের উপর নয়। তাই ফোটনের জাড্য ভর শূন্য হলেও মহাকর্ষ কাজ করে কারন ফোটনের শক্তি আছে। আবার প্রোটনের সমস্ত ভর শুধু হিগস মিথস্ক্রিয়া থেকে আসে না, প্রোটন মধ্যস্থ কোয়ার্ক কণাদের বিনিময়কারী গ্লুয়ন কণার গতিশক্তি থেকেও আসে। এই বিষয়গুলির জটিলতার মধ্যে আমরা যাব না, কিন্তু আমরা হিগস বোসন তথা হিগস ক্ষেত্রের গুরুত্ব সহজেই বুঝতে পারলাম কারণ হিগসের জন্যই কণারা ভর পায় বলেই মহাকর্ষ কাজ করে ও সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ হিগস কণা না থাকলে অন্যান্য মৌলকণা গুলি ভরহীনভাবে আলোর বেগে এখনও  ছুটে বেড়াত, কিছুই সৃষ্টি হত না। এবার আমরা আসব সার্ন গবেষনাগারে হিগস কণার পরীক্ষালব্ধ প্রমাণে যা তোলপাড় করে দিয়েছিল সারা পৃথিবী।


২য় পর্ব

          কণা পদার্থবিদ্যার অনেক অমিমাংসিত বিষয়, বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা ফান্ডামেন্টাল কণাসমূহের যে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সাহায্যে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন তাতে অনেক ফাঁক থেকে যাচ্ছিল। এ জন্য প্রায় অর্ধশতক আগে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে স্থান পাওয়া হিগস কণার তাত্বিক সম্ভাবনার প্রমাণও হয়ে উঠছিল অত্যন্ত জরুরী। এই মিসিং লিংক পূরণ করার জন্য প্রয়োজন এক্সপেরিমেন্টাল ডেটা। তত্ত্বানুসারে আলোর গতিতে মুখোমুখি প্রচন্ড শক্তির প্রোটন কণাদের সংঘর্ষ ঘটাতে পারলে অন্যান্য কণার সঙ্গে হিগস কণাও পাওয়া যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন আধুনিকতম ব্যবস্থা যেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী কণা ত্বরণযন্ত্রে এই সংঘর্ষ ঘটিয়ে পরীক্ষাগারে মিনি বিগ ব্যাং এর মত অবস্থা সৃষ্টি করা যায়। সার্ন (ইউরোপিয়ান অরগানাইজেশান ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ-CERN) এর গবেষানাগারে পরিকল্পনা করা হল এরকম একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সার্ন গবেষনাগারটি সুইজারল্যান্ডের সুইস-ফ্রান্স সিমান্তে ১৯৫৪ সালে স্থাপিত হয়েছিল। এই সার্নের তত্বাবধানেই গড়ে তোলা হল এযাবৎকালের বিশ্বের সর্ববৃহৎ যান্ত্রিক ব্যবস্থা, ১২ ফুট ব্যাসের রিং আকৃতির ২৭ কিমি দীর্ঘ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC),স্থাপন করা হল মাটির প্রায় ১৭৫ মিটার নিচে। এটি একটি হ্যাড্রন কোলাইডার অর্থাৎ যে যন্ত্রে নিউট্রন, প্রোটন এর মত হ্যাড্রন কণাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। এই বিশালাকৃতি টিউবটিকে সর্বক্ষণ - ২৭১.৩ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বজায় রাখতে ব্যবহার করা হয় তরল হিলিয়াম প্রবাহ। দশ বছর ধরে নির্মিত এই যন্ত্রে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় ১০০ দেশের দশ হাজার বিজ্ঞানী যার মধ্যে কলকাতার কয়েকজন বিজ্ঞানীও ছিলেন।

         এই লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের দুটি  পৃথক টিউবের মধ্যে প্রায় আলোর গতিতে বিপরিত মুখি দুটি অতি উচ্চ শক্তির প্রোটন বিম নির্দিষ্ট  অভিমুখে চালনা করা হয়, গাইড করানোর জন্য ব্যবহার করা হয় প্রায় দশ হাজার ম্যাগনেট। এল.এইচ.সি-র ভিতরে চারটি স্থানে প্রোটন বিমের সংঘর্ষ ঘটানোর ব্যবস্থা ও সার্ন এর কন্ট্রোল সেন্টার থেকে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা করা হয়। বিপরীত মুখি ধাবমান বিম দুটিকে অত্যন্ত সঙ্কুচিত করে সূচের চেয়েও সুক্ষ করা হলে, অতি ক্ষুদ্র জায়গায় সংঘর্ষের ফলে প্রচন্ড তাপ ও চাপে আকাঙ্খিত ফল অর্থাৎ বিগ ব্যাং এর সময়কার পরিস্থিতি সৃষ্টি সম্ভব। এরকম হাজার হাজার কোটি সংঘর্ষে কোটি কোটি কণা উৎপন্ন হলে, প্রতি এক হাজার কোটি সংঘর্ষে একটি হিগস কণা তৈরী হওয়ার সম্ভবনা সৃষ্টি হয়, তবে প্রাপ্ত কণার স্থায়িত্ব  হবে সেকেন্ডের কোটি ভগ্নাংশেরও কম। বিগ ব্যাং এর সময়ের অবস্থা পরীক্ষাগারে সৃষ্টি করা হলে তার প্রথম মাইক্রো সেকেন্ডে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় পদার্থের অবস্থা পর্যবেক্ষনলব্ধ তথ্য  থেকে ধারণা করা যেতে পারে কিভাবে দৃশ্যমান পদার্থের উৎপত্তি তথা ভর জেনারেট হয়। এল.এইচ.সিতে সংঘর্ষের ফলে যে মিনি বিগ ব্যাং হয় তাতে প্রোটন কণা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যে সমস্ত কণা উৎপন্ন হয় সেগুলি পার্টিকল ডিটেক্টরে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা হয়। প্রাপ্ত  বিপুল তথ্য বিশ্লেষন করে জানা যাবে অতি স্বল্পায়ু হিগস কণার অস্তিত্ব। কি বিপুল পরিমান তথ্য বিশ্লেষন করতে হয়েছিল সেটা বোঝা যায় দুটি ডিটেক্টরে প্রতি সেকেন্ডে গৃহিত তথ্য সংরক্ষন করতে প্রয়োজনীয় সিডির সংখ্যা থেকে, সেই সংখ্যাটি হল দু লক্ষ।

        সার্ন এর।HC চালু করার পর প্রোটন বিম এর সংঘর্ষ ঘটিয়ে প্রাপ্ত তথ্যবিশ্লেষণের কাজ চলতে থাকে। এই বিপুল কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত হাজার হাজার বিজ্ঞানীর অনলস প্রচেষ্টায়।HC-র ATLAS ও CMS  পরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে 126 Gev ভর বিশিষ্ট একটি কণা সনাক্ত করা গেলে সার্ন কতৃপক্ষ ৪-ঠা জুলাই ২০১২, এই পর্যবেক্ষনের কথা জানান ও এটি একটি হিগস কণার অস্তিত্বের স্বপক্ষে প্রমাণ বলে ঘোষণা করেন। এরপরও দীর্ঘ নয় মাস ধরে প্রাপ্ত তথ্য থেকে কণা ও তার ধর্মাবলী নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন চালিয়ে ১৪ই মার্চ, ২০১৩ প্রেস বিজ্ঞপ্তি মারফৎ পর্যবেক্ষনলব্ধ কণাকে শতকরা একশত ভাগ হিগস বোসন (Standard model।ike Higgs-Boson) কণা রূপে সনাক্ত করার কথা জানান। সার্ন কতৃপক্ষ আরও জানান হিগস কণার আরও তথ্য বা অন্যান্য প্রকারের হিগস কণার অনুসন্ধান কার্য চালিয়ে যাওয়া হবে। এই আবিস্কারের পরে নোবেল কতৃপক্ষ এই কণার তাত্বিক প্রবর্তক রূপে বিজ্ঞানী পিটার হিগস ও বিজ্ঞানী ইংলার্টকে যৌথভাবে ২০১৩ সালের নোবেল পুরষ্কার প্রদান করেন। পরীক্ষাগারে হিগস বোসন কণার অস্তিত্বের প্রমাণ বিজ্ঞানের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে, কিন্তু সেই হিগস বোসন কণাকে 'ঈশ্বর কণা' নামে অভিহিত করে তাতে ঈশ্বরত্ব আরোপের প্রচেষ্টা বিজ্ঞানচেতনাকে আচ্ছন্ন করার অপচেষ্টা ছাড়া যে কিছু নয়, এবারে সে প্রসঙ্গে আমরা কিছু বলার চেষ্টা করব।


৩য় পর্ব

              বিজ্ঞান মহলে প্রচলিত পদ্ধতি প্রকরণ মেনে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক, গবেষকদের অবদান ও  পারিপার্শ্বিকতা স্মরণে রেখে সাধারনত বিজ্ঞানের আবিস্কৃত বিষয়গুলির নামকরণ করা হয়ে থাকে। এই ভাবেই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বহু আকাঙ্খিত কণাটি দীর্ঘদিন ধরে তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে 'হিগস বোসন' কণা নামে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। নামকরণের মধ্য দিয়ে যেমন বৈজ্ঞানিকদের কৃতিত্বের স্বীকৃতির স্বাক্ষর মেলে, একইভাবে বিজ্ঞান গবেষণার ধারাবাহিক ইতিহাসেরও কিছুটা প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজের দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের পর যখন হিগস কণার অস্তিত্ব পরীক্ষাগারে প্রমানিত হল ততদিনে কণাটি 'ঈশ্বর কণা' রূপে জনমানসে এক অদ্ভুদ আলো আঁধারীর সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের পথে এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ না হয়ে বিষয়টি সাধারণের মধ্যে যেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানের পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়া রূপে প্রতিপন্ন হল। ঈশ্বর বিশ্বাসীর কাছে 'ঈশ্বর এক বিশ্বাসের ব্যাপার' কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এতে সব সন্দেহের নিরসন হয় না, বরং বিজ্ঞানের একটা সিলমোহর পেলে সেটা অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। তাই লেডারম্যানের বইটির 'ঈশ্বরকণা' নামকরন তাদের কাছে, হাতে একটা তুরুপের তাস হয়ে দেখা দিল। তারপর পরীক্ষাগারে 'হিগস বোসনের' অস্তিত্বের প্রমাণ মিডিয়ার কল্যাণে ঈশ্বরের সুক্ষতম অস্তিত্বের  প্রমাণরূপে জনমানসকে প্রভাবিত করল। অথচ লেডারম্যান কিন্তু বইটির নাম দিতে চেয়েছিলেন #গডড্যাম_পার্টিকল (#Goddamn_Particle)। আসলে দীর্ঘদিন ধরে কণাটির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া না যাওয়ায় বিজ্ঞানী পিটার হিগস বিরক্ত হয়ে একে গডড্যাম পার্টিকল বলতে শুরু করেছিলেন ও বৈজ্ঞানিক মহলে সেটাই মুখে মুখে গডড্যাম পার্টিকল (Goddamn particle অর্থাৎ হতচ্ছাড়া, পাঁজি) বলে প্রচলিত হয়েছিল। শোনা যায় প্রকাশক বইটির নাম গডড্যাম থেকে ড্যাম কেটে দিলেন, বইটির নাম হয়ে গেল 'গড পার্টিকল' স্বভাবতই বইটি পেল অভাবনীয় ব্যাবসায়িক সাফল্য।

'হিগস বোসনের' ঈশ্বরপ্রাপ্তি:

'ঈশ্বরকণা' (The God Particle) বইটির দৌলতে 'হিগস বোসন কণা' নামটি সাধারণ্যে 'ঈশ্বরকণা' নামে প্রচলিত হয়ে গেল। বিষয়টি অনেকেরই ভালো লাগে নি, জানা যায় স্বয়ং পিটার হিগস এতে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি নিজে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, এই অর্থে তাঁকে নাস্তিক বলা যায়। যাইহোক 'হিগস বোসন কণা'র নাম মানুষ না জানলেও 'ঈশ্বর কণা'র নাম বেশ পরিচিতি পেয়ে গেল। তারপর এল সার্ন-এর ঘোষনায় হিগস কণার অস্তিত্বের প্রমাণের মুহূর্ত, প্রচার মাধ্যম ঈশ্বর কণার আবিস্কারের কাহিনী ফলাও করে প্রচার করল। টিভি, খবরের কাগজ, পত্র পত্রিকায় হিগস কণা প্রতিভাত হল ঈশ্বরকণারূপে। এ যেন বিজ্ঞান গবেষনার এক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য নয়, এ হল ঈশ্বর সাধনার বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি। কষ্টার্জিত হিগস বোসন নামটি চাপা পড়ে গেল ঈশ্বরকণার নীচে, রীতিমত হাইজ্যাক বলা যায় আর কি! অনেকেই হয়তো বলতে পারেন, নামে কি এসে যায়, অন্তর্নিহিত সত্যটাই তো আসল, হিগস বোসন কণার নাম 'ঈশ্বর কণা' হলে ক্ষতি কি, কণাটির চরিত্র ধর্ম তো পাল্টে যাচ্ছে না। সংগত প্রশ্ন মনে হতে পারে, কিন্তু প্রশ্নকর্তার কেন মনে হচ্ছে না কণাটির প্রচলিত নামটিতে তারা সন্তুষ্ট নন কেন, সত্যেন্দ্র নাথ বসু থেকে পিটার হিগস পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রা পথে কণাটি নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের স্বীকৃতি বহন করা নাম কেন তাঁরা অন্য নামে ডাকবেন? আসলে কণাটির 'ঈশ্বর কণা' নাম দেওয়ার যুক্তিগ্রাহ্য কোন কারণ নেই। কণাটির চরিত্র ধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোন প্রমান হয়নি। কিন্তু ঈশ্বরবিশ্বাসীদের সৌজন্যে 'কণা'টির ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটে গেছে! এখানেই তাদের সুক্ষ কৌশল, একটি প্রাকৃতিক বিষয়কে অতিপ্রাকৃতিক, অলৌকিকতার মোড়কে রহস্যময়তা সৃষ্টি করে মানুষের যুক্তিবাদী মানসিকতাকে পঙ্গু করে রাখার চেষ্টা, বিজ্ঞানমনষ্কতার বিকাশ রুদ্ধ করার অপচেষ্টা। যে চেষ্টা প্রচলিত ধর্মমত গুলি অনবরত করে চলে, সেই চেষ্টাকে বিজ্ঞানের জগতে এনে ফেলা, তাকে কলুষিত করা। অর্থাৎ আমরা দেখতে পেলাম ক্ষেত্র বিশেষে নামেও অনেক কিছু এসে যায়। সব থেকে দুঃখের বিষয় বিজ্ঞানক্ষেত্রে যুক্ত কিছুলোক ঈশ্বরকণা নামটির যথেচ্ছ ব্যবহার করে চলেছেন যা মানুষের বিজ্ঞান চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখতেই সাহায্য করে।

         বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষনলব্ধ ফলাফল যৌক্তিক পদ্ধতিতে বিচার বিবেচনা বিশ্লেষন অনুধাবন করে যে বিশেষিকৃত জ্ঞান আমরা অর্জন করি সেটুকুই আমরা জেনেছি বলে দাবি করতে পারি, তার বেশীও নয় কমও নয়। এখানে আত্মগতভাবে কোন আরোপিত ধারণা পোষন প্রকৃতিকে তার সৃষ্টি, বিকাশ, ক্রিয়া পদ্ধতি সব কিছু জানার বোঝার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, আমাদের যুক্তিবোধ প্রগতিমুখি চিন্তাভাবনা সমগ্র প্রকৃতির প্রতিটি রহস্য সন্ধানে উৎসুক হতে ও প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করে, ফলস্বরূপ আমরা অজ্ঞনতার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হই।

বিশ্বপ্রকৃতির সমস্ত ঘটনা প্রবাহ, কার্য-কারণ সম্পর্ক সব কিছু জানার আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র স্বচ্ছ স্বাধীন সক্রিয় কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে, কোন অতিপ্রাকৃতিক শক্তির উপর নির্ভরতা থেকে নিশ্চেষ্ট হয়ে তার কাছে আত্মসমর্পন করে নয়। 'ঈশ্বরকণা' সেরকমই একটা মোহ বিস্তারকারী শব্দ যা বিশ্ব প্রকৃতির অপার রহস্য জানার চিরন্তন কৌতুহলী মানুষের মনে কিংবদন্তির সৃষ্টি করেছে যা বিজ্ঞান জগতে নিতান্ত বেমানান। পক্ষান্তরে শব্দটির অপ্রাসঙ্গিক ব্যবহার হিগস ক্ষেত্রের ক্রিয়ারও যথাযথ মূল্যায়ণ করে না। হিগস কণার আবিস্কার মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের পথে, মহাবিশ্বকে বোঝার পথের  উল্লেখযোগ্য মাইলফলক, সব রহস্য সমাধানের যাদুদন্ড নয়।

                 বিজ্ঞানী লেডারম্যান ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের কথা বলেন নি, সম্ভবত তিনি অজ্ঞেয়বাদী, তাঁর বইয়ে বর্ণিত ঈশ্বরকণা পদার্থ বিজ্ঞানের একটি টার্মের অতিরিক্ত কিছু নয়, তবু এধরণের শব্দের ব্যবহার অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে, তাতে লেখক যা বলতে চাননি সেটাও তাঁর বক্তব্য বলে অনেক সময় ধারনা জন্মায়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কোথাও প্রচলিত ঈশ্বর বিশ্বাসের কথা বলেছেন বলে জানা নেই। তিনি ঘোষিত নাস্তিকও সম্ভবত নন, কিন্তু তিনি ঈশ্বর শব্দটির প্রয়োগ করায় কেউ কেউ তাঁকে পরোক্ষে ঈশ্বর বিশ্বাসী বলার সুযোগ পেয়েছেন। 'এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম' বইটিতে স্টিফেন হকিং "ঈশ্বরের মন বুঝতে পারব" বলায় ভুল বোঝার অবকাশ থাকতে পারে ভেবেই সম্ভবত আবারও বলেছেন, "ঈশ্বরের মন বোঝা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি, যদি কোন ঈশ্বর থাকে যা আসলে নেই, তাহলে সেই ঈশ্বরের যা যা জানার সম্ভাবনা,আমরাও তাই জানতে পারব।আমি নাস্তিক।" অর্থাৎ ঈশ্বর শব্দটির অসতর্ক ব্যবহার ভুল বোঝানোর সুযোগ করে দেয় এ বিষয়ে তিনি পূর্ণ মাত্রায় সচেতন ছিলেন। অর্থাৎ মানুষ যা জানতে পারে ঈশ্বরের জানার দৌড় ততটুকুই, তাহলে 'ঈশ্বর' আর ঈশ্বর থাকলেন কোথায়? "মহাবিশ্বের সৃষ্টি ব্যাখ্যা করতে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রয়োজন নেই" হকিং এর এই বক্তব্যের সূত্র ধরে বলা যায় 'হিগস বোসনের' আবিস্কারে ঈশ্বর বিশ্বাসীদের উল্লসিত হবার কোন কারণ নেই, বরং অনন্যসাধারণ এই কণাটির আবিস্কারের মধ্য দিয়ে কণা পদার্থ বিজ্ঞান এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে যা হয়ত হকিং বর্ণিত বহু আকাঙ্খিত "থিয়োরি অফ এভরিথিং" মানুষের আয়ত্বে এনে দেবে, সেদিন হয়ত হিগস কণা ঈশ্বরের জীয়নকাঠি না হয়ে ঈশ্বরের মৃত্যুবাণ রূপে চিহ্নিত হবে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86933